দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর তার শরীরে রোগ অনুসন্ধান হচ্ছে না। ফলে জানা যাচ্ছে না প্রাণঘাতী ভাইরাসটি মানবদেহের কোন কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ক্ষতের সৃষ্টি করছে। আক্রান্তদের শরীরে কী কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। রোগীর কত ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
লক্ষণহীন রোগী আদৌ আছে কি না। বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় রোগীদের চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে সঠিক ওষুধ নির্ধারণও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় দেশে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অথচ সব দেশে করোনাভাইরাস একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। নিশ্চিত হয়ে রোগ নির্ধারণ এবং চিকিৎসা দেয়ার জন্যই বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত মৃতদেহের অটোপসি (মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধান) হচ্ছে।
ময়নাতদন্তের মাধ্যমে ক্ষত, প্রতিক্রিয়া এবং লক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছে; কিন্তু বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মরদেহ অটোপসি করার বিষয়টি ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস দেশের মানুষের শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ চিকিৎসক কেউ কিছুই জানতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অটোপসি করেই জানা সম্ভব নতুন রোগটি মানুষের শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তাই চীন, ইতালি, ব্রাজিল, ইংল্যান্ডসহ সব উন্নত দেশেই করোনা আক্রান্তদের মৃতদেহে রোগের অনুসন্ধান করে চলেছে।
এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কেরালা এবং শ্রীলংকায়ও অটোপসির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে যারা গাইডলাইন প্রণয়নে কাজ করেছেন তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেননি। দেশে করোনার সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে অবিলম্বে অটোপসি চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, আমাদের এখানে বলা হচ্ছে উপসর্গহীন রোগী আসছে-এটা সঠিক নয়। আসলে আমরা নিশ্চিত নই যে, করোনায় আক্রান্তদের কত ধরনের উপসর্গ থাকতে পারে। আমরা যেটুকু শুনেছি সে ধরনের লক্ষণ না থাকলে আমরা বলি উপসর্গহীন।
আসলে লক্ষণ বোঝা যাবে রোগটি মানবদেহে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে তার ওপর। এটা জানতে হলে দেহের ভেতরে দেখতে হবে। এ জন্য করোনায় আক্রান্ত মরদেহ কেটে দেখা দরকার ভাইরাসটি কোথায় ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য কী কী লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। তারা বলেন, করোনা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে মানুষের ওপর পৃথক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে আমাদের দেশে, সেই চিকিৎসা কার্যকর না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে রোগীর লক্ষণ আমাদের দেশের রোগীর মধ্যে দেখা না-ও যেতে পারে। অন্য কোনো উপসর্গ থাকতে পারে।
সে ক্ষেত্রে তার চিকিৎসাও আলাদা হবে। এতে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারে। এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদেশনির্ভরতা কমাতে হলে দেশে এ সংক্রান্ত রোগীর মরদেহের অটোপসি করে দেহের ক্ষত, লক্ষণ, রোগীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে তারা মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে শিশু হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, দেশকে করোনা চিকিৎসায় এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই অটোপসি (ময়নাতদন্ত) করতে হবে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে মানুষের ওপর ভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। চীনে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের শরীরে এক ধরনের প্রভাব দেখা গেছে, আমেরিকায় দেখা গেছে অন্য ধরনের প্রভাব।
তাই আক্রান্ত সব রোগীর চিকিৎসা এক ধরনের হবে না। একটি রোগ রোগীর ওপর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তার ওপর নির্ভর করে ওষুধ এবং চিকিৎসা কী ধরনের হবে।
অধ্যাপক শাহরিয়ার বলেন, চীন আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসে মাইক্রোথাম্বার বা শর্সের মতো ক্ষত পাওয়া গেছে। সম্প্রতি আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী রোগীদের শরীরে ‘হ্যাপি হাইপোস্কিমা’ বা সুখকর অক্সিজেনের ঘাটতি খুঁজে পেয়েছে।
অর্থাৎ রোগীর শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় অনেক নেমে গেছে; কিন্তু সেটা বোঝা যাচ্ছে না। রোগীর ভেতরে অক্সিজেন ঘাটতির কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাবে না; কিন্তু তার মৃত্যু হবে।
আবার শিশুদের মধ্যে ‘কাওয়াসাকির’ মতো রক্তনালি স্ফীত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যাতে শিশু মারা যাচ্ছে।
জানা গেছে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এমন একজন চীনা নাগরিকের ওপর অটোপসি পরিচালিত হয়। যেখানে প্রথম দেখা যায়, করোনাভাইরাস মানবদেহের ফুসফুসে কী ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি করে।
অটোপসিতে কোভিড-১৯-এর প্যাথলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলো তীব্র শ্বাসতন্ত্র সিন্ড্রোম (সার্স), মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসতন্ত্র সিন্ড্রোম (মার্স) এবং করোনাভাইরাসের একই পরিবারে হওয়ায় ফুসফুসে একই ধরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
পৃথক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির স্ট্রোকের মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে। তবে অন্য অঙ্গগুলোর কোনো ক্ষতি হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
চীনা রোগ বিশেষজ্ঞরা আরও ভালো চিকিৎসা এবং একটি ভ্যাকসিন বিকাশের জন্য এই রোগ সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য ১১টি অটোপসি পরিচালনা করেছেন। তবে এর রোগ-জীবাণু সংক্রান্ত প্রক্রিয়া এবং লক্ষণগুলো এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি।
প্রথম প্রকাশিত অটোপসির ফলাফলে উহান থেকে একজন ৮৫ বছর বয়সী ব্যক্তির ফুসফুসে সরিষার মতো ক্ষত পাওয়া গেছে। লিউ লিয়াং হলেন প্রথম ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যিনি গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ওই বৃদ্ধার মৃতদেহটি পরীক্ষা করেন।
ব্রাজিলের গবেষকরা স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ থেকে রক্ষার্থে সন্দেহভাজন করোনাভাইরাস মৃত্যুর ক্ষেত্রে ন্যূনতম আক্রমণাত্মক অটোপসি কৌশল ব্যবহার করছেন। প্যাথলজিস্টরা সম্ভাব্য সংক্রামক অঙ্গ, তরল এবং স্রাবের সংস্পর্শে আনেন।
ছয় বছর ইউনিভার্সিটি সাও পাওলো স্কুল অব মেডিসিনের হাসপাতাল দাস ক্লিনিকাসের গবেষকরা এ সংক্রান্ত কৌশল রপ্ত করছেন। যার মধ্যে আফ্রিকার ইবোলা প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা ব্যবহৃত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ড. সালদিভা বলেছেন, আমরা ব্যবহারের জন্য টিস্যু নমুনাগুলোর একটি জৈবিক ভাণ্ডার তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছি। যা ভাইরাস সংক্রমণের প্রক্রিয়া বুঝতে এবং রোগ নির্ণয় উন্নতি করতে সহায়তা করবে।
মস্তিষ্ক, হার্ট, ফুসফুস, প্লিহা, অন্ত্র এবং অণ্ডকোষের পাশাপাশি লালাগ্রন্থি থেকে নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই কর্মযজ্ঞে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো ব্যয়বহুল নয়। তবে কৌশলটির প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অটোপসি করে অনেক কিছু জানা সম্ভব, যা রোগ উপশমে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
আমাদের দেশে প্রণিত গাইডলাইনে এটি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন কি না, সেটা মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, ভাইরাসটি আমাদের কী ধরনের ক্ষতি করছে, তা আমরা জানি না।
মানবদেহে করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। ইতালিতে অটোপসি করে মানবদেহে এই ভাইরাসের বিভিন্ন প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
মৃতদেহের রোগ অনুসন্ধান করা ছাড়া রোগ এবং রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত যে ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ইতোমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখানে অটোপসি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
লক্ষণহীন রোগী আদৌ আছে কি না। বিষয়গুলো সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় রোগীদের চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে সঠিক ওষুধ নির্ধারণও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় দেশে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যা বলছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। অথচ সব দেশে করোনাভাইরাস একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। নিশ্চিত হয়ে রোগ নির্ধারণ এবং চিকিৎসা দেয়ার জন্যই বিভিন্ন দেশে করোনায় আক্রান্ত মৃতদেহের অটোপসি (মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধান) হচ্ছে।
ময়নাতদন্তের মাধ্যমে ক্ষত, প্রতিক্রিয়া এবং লক্ষণ সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছে; কিন্তু বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের মরদেহ অটোপসি করার বিষয়টি ক্লিনিক্যাল গাইডলাইনে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস দেশের মানুষের শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, সে সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ চিকিৎসক কেউ কিছুই জানতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু অটোপসি করেই জানা সম্ভব নতুন রোগটি মানুষের শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। তাই চীন, ইতালি, ব্রাজিল, ইংল্যান্ডসহ সব উন্নত দেশেই করোনা আক্রান্তদের মৃতদেহে রোগের অনুসন্ধান করে চলেছে।
এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কেরালা এবং শ্রীলংকায়ও অটোপসির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে যারা গাইডলাইন প্রণয়নে কাজ করেছেন তারা এ বিষয়ে গুরুত্ব দেননি। দেশে করোনার সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে অবিলম্বে অটোপসি চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলেন, আমাদের এখানে বলা হচ্ছে উপসর্গহীন রোগী আসছে-এটা সঠিক নয়। আসলে আমরা নিশ্চিত নই যে, করোনায় আক্রান্তদের কত ধরনের উপসর্গ থাকতে পারে। আমরা যেটুকু শুনেছি সে ধরনের লক্ষণ না থাকলে আমরা বলি উপসর্গহীন।
আসলে লক্ষণ বোঝা যাবে রোগটি মানবদেহে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে তার ওপর। এটা জানতে হলে দেহের ভেতরে দেখতে হবে। এ জন্য করোনায় আক্রান্ত মরদেহ কেটে দেখা দরকার ভাইরাসটি কোথায় ক্ষত সৃষ্টি করেছে।
শরীরে কী ধরনের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য কী কী লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। তারা বলেন, করোনা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে মানুষের ওপর পৃথক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে আমাদের দেশে, সেই চিকিৎসা কার্যকর না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে রোগীর লক্ষণ আমাদের দেশের রোগীর মধ্যে দেখা না-ও যেতে পারে। অন্য কোনো উপসর্গ থাকতে পারে।
সে ক্ষেত্রে তার চিকিৎসাও আলাদা হবে। এতে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করতে পারে। এই রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদেশনির্ভরতা কমাতে হলে দেশে এ সংক্রান্ত রোগীর মরদেহের অটোপসি করে দেহের ক্ষত, লক্ষণ, রোগীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে তারা মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে শিশু হৃদরোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, দেশকে করোনা চিকিৎসায় এগিয়ে নিতে হলে অবশ্যই অটোপসি (ময়নাতদন্ত) করতে হবে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে মানুষের ওপর ভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। চীনে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের শরীরে এক ধরনের প্রভাব দেখা গেছে, আমেরিকায় দেখা গেছে অন্য ধরনের প্রভাব।
তাই আক্রান্ত সব রোগীর চিকিৎসা এক ধরনের হবে না। একটি রোগ রোগীর ওপর যে ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তার ওপর নির্ভর করে ওষুধ এবং চিকিৎসা কী ধরনের হবে।
অধ্যাপক শাহরিয়ার বলেন, চীন আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসে মাইক্রোথাম্বার বা শর্সের মতো ক্ষত পাওয়া গেছে। সম্প্রতি আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী রোগীদের শরীরে ‘হ্যাপি হাইপোস্কিমা’ বা সুখকর অক্সিজেনের ঘাটতি খুঁজে পেয়েছে।
অর্থাৎ রোগীর শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ স্বাভাবিক মাত্রার তুলনায় অনেক নেমে গেছে; কিন্তু সেটা বোঝা যাচ্ছে না। রোগীর ভেতরে অক্সিজেন ঘাটতির কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাবে না; কিন্তু তার মৃত্যু হবে।
আবার শিশুদের মধ্যে ‘কাওয়াসাকির’ মতো রক্তনালি স্ফীত হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যাতে শিশু মারা যাচ্ছে।
জানা গেছে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এমন একজন চীনা নাগরিকের ওপর অটোপসি পরিচালিত হয়। যেখানে প্রথম দেখা যায়, করোনাভাইরাস মানবদেহের ফুসফুসে কী ধরনের ক্ষতের সৃষ্টি করে।
অটোপসিতে কোভিড-১৯-এর প্যাথলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যগুলো তীব্র শ্বাসতন্ত্র সিন্ড্রোম (সার্স), মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসতন্ত্র সিন্ড্রোম (মার্স) এবং করোনাভাইরাসের একই পরিবারে হওয়ায় ফুসফুসে একই ধরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
পৃথক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির স্ট্রোকের মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে। তবে অন্য অঙ্গগুলোর কোনো ক্ষতি হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
চীনা রোগ বিশেষজ্ঞরা আরও ভালো চিকিৎসা এবং একটি ভ্যাকসিন বিকাশের জন্য এই রোগ সম্পর্কে ধারণা অর্জনের জন্য ১১টি অটোপসি পরিচালনা করেছেন। তবে এর রোগ-জীবাণু সংক্রান্ত প্রক্রিয়া এবং লক্ষণগুলো এখনও পুরোপুরি বোঝা যায়নি।
প্রথম প্রকাশিত অটোপসির ফলাফলে উহান থেকে একজন ৮৫ বছর বয়সী ব্যক্তির ফুসফুসে সরিষার মতো ক্ষত পাওয়া গেছে। লিউ লিয়াং হলেন প্রথম ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ যিনি গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ওই বৃদ্ধার মৃতদেহটি পরীক্ষা করেন।
ব্রাজিলের গবেষকরা স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ থেকে রক্ষার্থে সন্দেহভাজন করোনাভাইরাস মৃত্যুর ক্ষেত্রে ন্যূনতম আক্রমণাত্মক অটোপসি কৌশল ব্যবহার করছেন। প্যাথলজিস্টরা সম্ভাব্য সংক্রামক অঙ্গ, তরল এবং স্রাবের সংস্পর্শে আনেন।
ছয় বছর ইউনিভার্সিটি সাও পাওলো স্কুল অব মেডিসিনের হাসপাতাল দাস ক্লিনিকাসের গবেষকরা এ সংক্রান্ত কৌশল রপ্ত করছেন। যার মধ্যে আফ্রিকার ইবোলা প্রাদুর্ভাবের সময় স্বাস্থ্যকর্মীদের দ্বারা ব্যবহৃত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ড. সালদিভা বলেছেন, আমরা ব্যবহারের জন্য টিস্যু নমুনাগুলোর একটি জৈবিক ভাণ্ডার তৈরি করার পরিকল্পনা নিয়েছি। যা ভাইরাস সংক্রমণের প্রক্রিয়া বুঝতে এবং রোগ নির্ণয় উন্নতি করতে সহায়তা করবে।
মস্তিষ্ক, হার্ট, ফুসফুস, প্লিহা, অন্ত্র এবং অণ্ডকোষের পাশাপাশি লালাগ্রন্থি থেকে নমুনাগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এই কর্মযজ্ঞে ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো ব্যয়বহুল নয়। তবে কৌশলটির প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।
জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অটোপসি করে অনেক কিছু জানা সম্ভব, যা রোগ উপশমে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
আমাদের দেশে প্রণিত গাইডলাইনে এটি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন কি না, সেটা মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন।
এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, ভাইরাসটি আমাদের কী ধরনের ক্ষতি করছে, তা আমরা জানি না।
মানবদেহে করোনাভাইরাসের প্রভাব সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে মৃতদেহে রোগ অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে। ইতালিতে অটোপসি করে মানবদেহে এই ভাইরাসের বিভিন্ন প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
মৃতদেহের রোগ অনুসন্ধান করা ছাড়া রোগ এবং রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত যে ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ইতোমধ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে, সেখানে অটোপসি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন